'এই গাছটা কাটিস না বাবা।' বলেই হিরু কাকা আমাদের পায়ের ওপর পড়ে গেলেন। আমরা আঁতকে উঠলাম। হিরু কাকা আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, আমাদের বাবা-চাচারাও তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন। আর তিনি আমাদের পা ধরতে আসছেন এখন। ছিঃ, কি লজ্জা!

হাসান তাড়াতাড়ি তাকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বললো, 'আপনি এমন করছেন কেন? একটাই তো গাছ। এই গাছ না কাটলে এখানে স্কুলঘরটা বানানো যাবে? কতো ছেলে-মেয়ে পড়বে এখানে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হোক, আপনি চাননা?'
হিরু কাকা বললেন, 'তা চাবো না কেন? কিন্তু পড়ালেখার জন্য গ্রামে তো সব মানুষ থাকা লাগবে। গ্রামের মানুষ মারা গেলে স্কুলে পড়বে কে?'
'গাছ কাটলে গ্রামের মানুষ মারা যাবে?'
'হ্যাঁ।'
আমরা হেসে ফেললাম। উনাকে যতোই সম্মান করি না কেন, বাস্তবতা মানতে হবে। বাস্তবতা হলো, উনার বয়স হয়েছে। এই বয়সের মানুষদের মাথা ঠিক থাকে না।
আমরা হিরু কাকাকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েই গাছটা কেটে ফেললাম। এখানেই কিছুদিন পর গড়ে উঠলো আমাদের স্বপ্নের স্কুল। ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা শুরু করলো এখানে।
গেছো - ভৌতিক  Horror Story


বর্ষাকাল। স্কুলটা শুরু হবার পর একবছর কেটে গেছে‌। হিরু কাকা মারা গেছেন তাও প্রায় একবছর হয়ে গেলো। গাছটা কাটার কিছুদিন পরই হিরু কাকা মারা যান। মারা যাবার আগে তিনি বারবার বলেছিলেন, 'তোরা কিন্তু খুব খারাপ করেছিস। তোরা কেউ বাঁচবি না। যা, সময় থাকতেই গ্রাম ছেড়ে পালা।'
আমরা কেউ গ্রাম ছেড়ে পালাইনি। এক বছর কেটে গেছে, এক হিরু কাকার বদলে গ্রামে কেউ মরেওনি। আমাদের জীবন সুখে শান্তিতে কেটে যাচ্ছে।
সেসময়ই, এক বর্ষণমুখর রাত্রিবেলা, চারদিক যখন নিঝুম, আমাদের গ্রামের কালু ব্যাপারি তখন মারা গেলেন।
মারা যাওয়াটা বিষয় না। বিষয় হলো, তিনি যেভাবে মারা যান, সেটা। তার লাশটা গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। কে যেন তাকে মেরে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে।
কালু ব্যাপারি নতুন বিয়ে করেছিলেন। তিনকুলে আর কেউ নেই তার। বউটিই কেবল ছিলো, তারও কালুর সাথে বনিবনা হচ্ছিলো না। শোনা যায়, বউটির একটা প্রেমিক ছিলো। সবাই বলাবলি করছিলো, এটা সেই গোপন প্রেমিকেরই কাজ।
বউটা অবশ্য অনেকক্ষণ ধরে হাছড়ে পিছড়ে কান্নার অভিনয় করলো। তার অভিনয়টুকু কারো মন ভরাতে পারলো না।
তার দুদিন পর, আমাদের গাঁয়ের মজু হাওলাদারও খুন হয়ে গেল। ঠিক একই ভাবে, গাছের সাথে ঝোলানো অবস্থায়। এবার সবার মনে একটু ভয় ঢুকলো, ব্যাপার-স্যাপার কি? কে এসব খুন করাচ্ছে?
যে দুজন মরলো, দুজনই নাজিব মহাজনের কাছের লোক। নাজিব মহাজন এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী, ধনী মানুষ। সামনের মাসে চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়াবেন। দাঁড়ালেই যে পাশ, সবাই চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে‌। তার এলাকায় বেশ সুনাম, সম্পদ গড়ার পাশাপাশি মানুষের সেবার কাজও করেন। আমাদের স্কুলটা করার পেছনেও তার অঢেল শ্রম ও সম্পদ রয়েছে।
যেহেতু যে দুজন মারা গেছে, তারা দুজনেই নাজিব মহাজনের কাছের লোক, সবাই বুঝে গেলো, কাজগুলো নাজিব মহাজনের অ্যান্টিপার্টির। জিততে পারবে না জেনে তারা এসব খুন-খারাবির মধ্যে ঢুকে গেছে‌। কথাটা নাজিব মহাজনের কানেও গেলো‌। তিনি গুরুত্বের সাথেই নিলেন ব্যাপারটা। পুলিশকে জানালেন। তারা অ্যান্টিপার্টির লোকজনের ওপর কড়া নজর রাখলো।
এতোকিছুর মধ্যেও তৃতীয় খুনটা হয়ে গেলো। এও নাজিব মহাজনের লোক, তবে অতোটা কাছের নয়। নাম নুরুদ্দিন। লোকটার কাঠ-কাটার কল ছিলো, নাজিব মহাজন তাতে মাঝে মাঝে কাঠ চেরাই করাতেন।
নুরুদ্দিন মারা যাওয়ার পর সবাই এবার দারুন ভয় পেলো। নাজিব মহাজনের কাছের-দূরের লোক সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো। তবে কথা হলো, গাঁয়ের সবার সাথেই নাজিব মহাজনের কোনো না কোনো সম্পর্ক আছেই। তাই বলা যায় পুরো গাঁ জুড়েই আতংকের এক ঢেউ বয়ে গেলো। সন্ধ্যার পর আর কেউ বের হয় না। রাতে পুরো গ্রাম নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে যায়‌। মনে হয় গ্রামটা রাতারাতি যেন ভূতুড়ে গ্রাম হয়ে গেছে।
যুবায়ের এসবের কিছুই জানে না। সে ঢাকায় থাকে, ওখানে অফিস পিওনের চাকরি করে। ছুটিতে বাড়ি আসছিলো, সন্ধ্যার পর কোনো গাড়ি না পেয়ে হেঁটেই রওনা দিয়েছিলো‌। ওদের বাসায় ঢোকার আগে যে বড় রেনডি গাছটা পড়ে, তার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় সে দেখে, কে যেন বসে আছে‌‌।
যুবায়ের প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে সামলে উঠে বলে, 'কেডারে? গাছের ওপর কেডা?'
যে জিনিসটা গাছের ওপর বসে ছিলো, সেটা একবার নিচে তাকায়‌। তাকে দেখে যুবায়ের কাঁপতে কাঁপতে বাসায় চলে যায়। পরের তিনদিন তার তীব্র জ্বর থাকে। জ্বর থেকে সেরে উঠলে সে জানায়, যে জিনিস সে গাছের ওপর দেখেছে, অমন ভয়ংকর জিনিস সে কখনো দেখেনি। ওটা পৃথিবীর কেউ হতে পারে না।
ব্যস, পুরো গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। গ্রামে গেছো ভূত চলে এসেছে। ওটার হাত থেকে নিস্তার নাই।
কিন্তু ওটা এলো কোথা থেকে? বিস্তর আলোচনার পর সবার হঠাৎ হিরু কাকুর কথা মনে পড়ে গেলো। হিরু কাকা না বলেছিলেন, গাছ না কাটতে? তবে গ্রামের সবাই মারা পড়বে? তবে কি কাকা এটার কথাই বলেছিলেন?
হ্যাঁ। এটার কথাই। হিরু কাকার বোন সুলেখা তাই সাক্ষ্য দিলেন। মারা যাবার আগে নাকি হিরু কাকা বলেছিলেন, ঐ গাছের ওপর কিছু একটা থাকে। কি থাকে তা তিনি বলে যেতে পারেননি। ঐটাই তবে সেই গাছের জীব। এটাই এখন এসেছে সবার বিনাশ করতে।
দুয়ে দুয়ে চার মিলতে থাকে। যে জায়গায় স্কুলটা তৈরি হয়, অর্থাৎ সেই গাছের জায়গাটা, সেটা আসলে হিরু কাকারই জায়গা। গাছটা তার দাদার লাগানো। নাজিব মহাজন জায়গাটা দখল করে ওতে স্কুল তৈরি করেন। গাছের ওপর কিছু থাকলে ওটা হিরু কাকার থেকে আর বেশি কারো জানবার কথা না। যে তিনজন মারা যায়, এদের মধ্যে দুজন- কালু ব্যাপারি আর মজু হাওলাদার সবার প্রথমে গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছিলো। আর কাটা গাছটা চেরাই করা হয়েছিলো নুরুদ্দিনের করাতকলে।
নাজিব মহাজন দেখলেন, তার জনসমর্থন কমে যাচ্ছে। হিরু কাকার জমিটা যে তিনি দখল করেছিলেন, ওটা গ্রামের বেশি কেউ জানতো না। কিন্তু এখন ঘটনাটা প্রকাশ পেয়ে গেছে। এটা নিশ্চয়ই তার অ্যান্টিপার্টির কাজ। ভূত-প্রেত কিচ্ছু না। তার অপকর্ম প্রকাশ করতেই এসব কাহিনী ছড়াচ্ছে তারা।
এক শুক্রবার জুমার নামাজের পর তিনি জ্বালাময়ী বক্তব্য দিলেন। বক্তব্যের বিষয়, গ্রামের মানুষজন কেন এইসব আজেবাজে ভূত-জ্বীনের গল্প বিশ্বাস করছে? এখন আধুনিক যুগ। এসব কাহিনী আর চলে না।এসব তার অ্যান্টিপার্টির কাজ। তাদের বানানো কুৎসা মানুষ কেন বিশ্বাস করছে? তিনি কি গ্রামের মানুষদের জন্য কিছুই করেন নাই?
সবাই ভীষণ লজ্জা পেলো। আসলেই তো। নজিব মহাজনের এতো অবদান তারা কেমনে ভুলে গেলো। ঠিক হলো, আজ রাতে সবাই একসাথে বের হবে। কে গেছো-ভূত সেজে তাদের ভয় দেখাচ্ছে, ওরে ধরে তার পিন্ডি চটকানো হবে আজকে।
সন্ধ্যার পর আজকে গ্রামে সাজ সাজ রব। সবাই টর্চ মশাল হারিকেন সবকিছু নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। মানুষদের উৎসাহ দিতে মাইক ভাড়া করা হয়েছে, মাইকে বক্তারা জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। নাজিব মহাজন একটা বড় দল নিয়ে নিজেই নেমে পড়েছেন। হৈ চৈ করতে করতে দলটা এগোচ্ছে বড় শ্যাওড়া গাছটার দিকে। ওখানেই সবার প্রথমে কালু ব্যাপারির লাশটা পাওয়া গিয়েছিলো।
গাছটার কাছে এসেই দলটা একটা ধাক্কা খেলো। গাছের ওপর আসলেই কিছু একটা বসে আছে। ওটার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে পা-টা বেশ লম্বা। লোকদের কথা গেছে থেমে‌। যারা দলের পেছনে ছিলো, তারা অনেকে পিঠটান দিয়েছে। নজিব মহাজনও কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন। তবে ঘাবড়ালে চলবে না।আজ বদমায়েশটাকে তিনি পেয়েছেন, এই শালার জন্যই তার এতো হেনস্তা। শালাকে আজ একটা শিক্ষা দিতে হবে, এইটা মানুষই হোক আর ভূতই হোক।
তিনি বেশ জোরেই হাক দিলেন, 'কেডারে? গাছের ওপর কেডা? সাহস থাকে তো নাইমা সামনে আয়। ব্যাডা মাইনষের মতো মোকাবিলা কর।'
জিনিসটা আস্তে আস্তে নামলো গাছ থেকে। সেদিন সেই সন্ধ্যাবেলা, সেই আলো-আধারির মাঝে, বৃষ্টিভেজা অদ্ভুত নির্জনতার মাঝে, সবাই দেখলো, তাদের সামনে হিরু কাকা দাঁড়িয়ে আছে। সেই হিরু কাকা, যিনি এক বছর আগে মারা গেছেন। সেই হিরু কাকা, যার লাশ তারা নিজেরা কবরে দাফন করে এসেছিলো।
সেদিন কে কিভাবে বাড়ির পথে পালিয়েছিলাম, মনে নেই। আমরা অনেকেই সেদিন বাড়িতেও ফিরিনি, এক দৌড়ে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিলাম। তার পরদিন যারা গ্রামে ছিলো, তারাও গ্রাম ছাড়লো। গ্রামটা পুরো জনশূন্য হয়ে পড়লো। নাজিব মহাজনের লাশটা যে গাছ থেকে ঝুলছিলো, সেটা নামিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করার মতো কেউ আর ছিলো না।

Post a Comment

Previous Post Next Post